চলমান COVID-19 মহামারীতে ভাইরাসে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার জন্য বিশেষ প্রয়োজন মেডিকেল অক্সিজেন । দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সীমিত সরবরাহ এবং সেই সাথে অপর্যাপ্ত তরল অক্সিজেন মহামারী পীড়িত ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। হাসপাতাল গুলো oxygen concentrator র অভাবে মুমূর্ষু রুগীদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন-র ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে । হৃদয় বিদারক কঠিন সত্য যে রুগীর স্বজনেরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল দৌড়েও অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করতে অপারগ। একটি oxygen concentrator -র অভাবে ভুক্তভুগীরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার আপন জনকে প্রাণ রক্ষায় সাহায্য করতে পারছে না । একটি portable oxygen concentrator কেবল মাত্র একজন মুমূর্ষু রুগীর শ্বাসকষ্টকেই সহায়তা করতে পারে তা নয়, রুগীকে বাঁচতেও সহায়তা করবে।

সারা বিশ্ব যখন COVID-19 যুদ্ধে লিপ্ত, পরিশ্রান্ত – এমনি একটি কঠিন সময়ে বুয়েট ৮২ (পাশের বছর) ব্যাচের বেশ কিছু উদ্যোগী প্রকৌশলী স্বেচ্ছায় সক্রিয় ভাবে একসাথে এগিয়ে আসে; উদ্দেশ্য একটি- কি করে তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে COVID-19 যুদ্ধকে তারা মোকাবেলা করতে পারে ? ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম zoom-র কল্যাণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই ব্যাচের বেশ কিছু মেধাবী প্রকৌশলী নিজেদের মাঝে আবার নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলে। আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া সহ বাংলাদেশে বসবাস রত সহপাঠীদের একটি দল oxygen concentrator –র ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টের কাজে লেগে যায়। লক্ষ্য হিসেবে বলা যায় – জন্মভূমির আলো, বাতাস, পানিতে বেড়ে ওঠার প্রতিদান আর সেই সাথে দেশের মানুষের বিপর্যয়ে, তাদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যদি কিছু একটু করা যায়। তারা মনে প্রাণে চাইলো যে বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কম দামে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূলনীতি অনুসরণ করে একটি উত্তম portable oxygen concentrator ডিজাইন তৈরি করতে হবে ।

যে কথা না বললেই নয় যে বুয়েট ৮২ হচ্ছে সেই ব্যাচ যাদের স্বাধীনতার পর দুই বছরে (১৯৭৬, ৭৭) HSC পাশ করা ছাত্র-ছাত্রী দের একসাথে একই ব্যাচে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হয়েছে। এরা যুদ্ধোত্তর সেশন জটের প্রথম শিকার। সেই বুয়েট ৮২ সম্প্রতি “OxyNLife” নামে একটি কার্যকরী অক্সিজেন কনসেন্টেটরের প্রোটোটাইপের “নকশা এবং বিকাশ” (R&D) প্রক্রিয়া সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে। তারা এখন এই নকশা এবং প্রোটোটাইপ কোন আগ্রহী প্রস্তুতকারকের হাতে হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তুত। উল্লেখ্য যে এই “OxyNLife” প্রোটোটাইপটি নিশ্চিত ভাবে “ISO 80601-2-69:2014 of the Medical Electrical Equipment – Part 2-69” বা (WHO) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সকল নির্দেশিকা ও ব্যবহার বিধি অনুসরণ করে ডিজাইন ও তৈরি করা হয়েছে। যন্ত্রটি পরিচালিত হচ্ছে WHO নির্ধারিত বৈদ্যুতিক শক্তি ৭০ ওয়াট/এলপিএম-এ।

বুয়েট’৮২-এর সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক এস. এম. লুতফুল কবীর ও অপর এক সদস্য সিঙ্গাপুরের এনইউএস-এর অধ্যাপক শামছুজ্জামান ফারুক এটি তৈরীর কাজে নেতৃত্ব দেয়। একদল প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাত্র ছয় মাসের মাথায় এর প্রটোটাইপ তৈরী করে ফেলে। বুয়েটের আইআইসিটি, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এই কাজে বিশেষ সহায়তা প্রদান করে।

বর্তমানে দেশে অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর এর বাজারমূল্য প্রকারভেদে টাকা ৪০,০০০ থেকে ৮o,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রাথমিক মূল্যায়নে এই প্রোটোটাইপটির উৎপাদন খরচ এবং বাজারমূল্য তার প্রতিযোগী oxygen concentrator গুলোর বাজার মূল্যের চেয়ে বেশ খানিকটা কম হবে। যন্ত্রটির ওজন ২১ কেজি এবং এটি সহজ পরিবহনযোগ্য। । মেশিনটির ডিজাইন প্রক্রিয়ার পেছনে সর্বদাই বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে যেন দেশের যেকোনো গ্রামে গঞ্জে বিদ্যুৎ প্রবাহের সাময়িক অনুপস্থিতেও এটি ব্যবহার করা যায় – তাই মেশিনটিতে সহজে IPS সংযোগ দেবার সুব্যবস্থা আছে। একটানা এক সপ্তাহ যন্ত্রটি চালিয়ে রেখে অক্সিজেন উৎপাদনের কোন তারতম্য দেখা যায় নি। সম্প্রতি একদল ডাক্তার এটি পরীক্ষা করে এর পারফরম্যান্স সন্তোষজনক হিসেবে মতামত ব্যক্ত করেছে।

আরও কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য:

  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বিশ্বের সেরা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে “OxyNLife” তৈরি।
  • নিরাপত্তা ও সতর্কীকরণের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো যেমন, তাপমাত্রা ও প্রেশার বৃদ্ধি প্রতিরোধ, অক্সিজেন প্রবাহ সেন্সর ইত্যাদি- বিশেষ খেয়াল করে ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
  • শব্দের মাত্রা কমানোর জন্য ভিতরে শব্দপ্রতিরক্ষা মূলক স্তর বসানো হয়েছে।
    এই মেশিনটি করোনা ছাড়াও COPD-সহ শ্বাসকষ্ট জনিত অন্য রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রুগীর শ্বাসকষ্টকে লাঘব করে মেডিকেল অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করবে। COVID-19 একদিন পরাজিত হবে, মানুষ করোনা মুক্ত হবে-তবে মুমূর্ষু রুগীর শ্বাসকষ্টকে সহায়তা করতে মেডিকেল অক্সিজেনের প্রয়োজন থেকেই যাবে। মেশিনটির সার্বজনীন ব্যবহার ভবিষ্যতের করোনা পরাজিত বিশ্বে থেমে থাকবে না।